খেজুরের রস আহরণে ব্যাস্ত ভোলার গাছিরা

দৈনিক ভোলা বার্তা,  হেমন্তের শুরুতে হালকা কুয়াশা আর হিমেল হাওয়ায় উপকূলে এখন শীতের আমেজ শুরু হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় উপকূলীয় জেলা ভোলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে শুরু হয়েছে খেজুর রস আহরণের মৌসুম। কুয়াশা উড়ছে সকালের বাতাসে, দ্বীপ ভোলার জন জীবনের স্বাভাবিক রুটিনে পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। রাস্তায়, জমিতে কিংবা পুকুরে, মাঠে-ঘাটে খেজুরের গাছের আশেপাশে মানুষের আনাগোনা বাড়ছে। খেজুর গাছ থেকে রস আহরণের যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন গাছিরা। জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখতে খেঁজুর গাছের ভূমিকা অপরিসীম। এ জেলায় এখনো বেশকিছু খেঁজুর গাছ দেখা যায়। ইটের ভাটায় অবাঁধে গাছ পোড়ানো এবং সঠিকমত গাছ কাটার কৌশল না জানার কারণে, সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে ক্রমশে খেঁজুরগাছ ও রসের হ্রাস পাচ্ছে। প্রতি বছরের ন্যায় এবারও শীতের শুরুতেই ভোলা জেলার ৭টি উপজেলা জুড়ে গাছীরা খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন গ্রামের গাছিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, খেজুরের রস প্রধানত চার প্রকার, জিড়েন রস, সাঁজ বা সন্ধ্যা রস, বাসি রস বা ভোর বেলার রস এবং উলারস।একটি খেজুর গাছ থেকে রস পেতে হলে প্রায় চল্লিশ দিন বিভিন্ন পর্যায়ের পরিচর্যা করতে হয়, তারপর রস আহরণের পালা। প্রতিদিন বিকালে খেজুর গাছের সাদা অংশ পরিষ্কার করে ছোট-বড় মাটির কলস বেঁধে রাখা হয় রসের জন্য। পরদিন সকালে ওইসব গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে বিক্রি করা হয়। চরফ্যাসন উপজেলার নীলকমল ইউনিয়নের চরযমুনা গ্রামের নুরমোহাম্মদ, নুরাবাদ ইউনিয়নের চরতোফাজ্জল গ্রামের শুক্কুর আলী, অাহম্মেদপুর ইউনিয়নের শুকনাখালীর শাহাজাহান গাছী জানান, শীত মৌসুমের শুরুতেই খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করা হয়। বছরের পাঁচ মাস রস সংগ্রহ করা যায়। এ রস থেকে বিভিন্ন রকমের পাটালি ও লালি গুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন তারা। তারা আরো জানান, শীতের পিঠা ও পায়েসের জন্য খেজুরের রস ও গুড়ের বাড়তি চাহিদা রয়েছে। বাজারে প্রতি কেজি খেজুরের গুড় বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়। তবে খেজুর গাছ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। তাই একসময় হয়তো খেজুর রসের ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে। এজন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বেশি বেশি খেজুর গাছ রোপণ করা প্রয়োজন বলেও জানান গাছিরা। ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা ইউনিয়নের শিহাব উদ্দিন নামে গাছি জানান, শীত মৌসুমের শুরু থেকেই খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করা হয়। শীতের প্রায় চার মাস রস সংগ্রহ করা যায়। এই রস থেকে বিভিন্ন রকমের পাটালি ও লালি গুড় তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে আমরা সংসার চালাই। তিনি আরও বলেন, ‘শীতের পিঠা ও পায়েসের জন্য খেজুরের রস ও গুড়ের বাড়তি চাহিদা রয়েছে। আমরা এখানে ১০০ টাকা দরে প্রতিকেজি খেজুরের গুড় বিক্রি করি। এছাড়াও এক কলস রস প্রকার ভেদে এক থেকে দেড়শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মনপুরা উপজেলার হাজিরহাট ইউনিয়নের ইউসুফ আলী নামে এক গাছি জানান, বাংলা আশ্বিন মাস থেকে সাধারণত রস সংগ্রহ শুরু। তবে পৌষ ও মাঘ মাসে সবচেয়ে বেশি রস পাওয়া যায়। এই সময় শীতের প্রকোপ থাকে সবচেয়ে বেশি। আবহাওয়া ঠাণ্ডা থাকলে রসও বেশি পাওয়া যায়। লালমোহন উপলজেলার চরউমেদ ইউনিয়নের খেজুর রস ক্রেতা ফয়েজ হাওলাদার ও সুমন জানান, ‘শীতের সকালে গাছ থেকে নামানো কাঁচা রসের স্বাদ বর্ণনা করা সম্ভব নয়। এছাড়াও জ্বাল দেওয়া রসের তৈরি বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার অতুলনীয়। মামুন বেপারী নামে এক গুড় ক্রেতা জানান, খেজুরের রসের পাটালি গুড়েরও ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এই গুড় দিয়ে হরেক রকম পিঠা বানায় গাঁয়ের বধূরা। আর এই পিঠা বানানো ঘিরে শিশু-বৃদ্ধার বসে থাকার দৃশ্য বাংলার এক পুরনো সংস্কৃতিরই অংশ। শীত নামলে কষ্টের পাশাপাশি পিঠাপুলির আনন্দও জমে ওঠে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক কৃষিবিদ বিনয় কৃষ্ণ দেবনাথ বলেন, খেজুর গাছ আমাদের অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এর পরিকল্পিত আবাদ তেমন নেই, নির্বিচারে খেজুর গাছ কাটা হচ্ছে, যাহা পল্লী বাংলার পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। খেজুর গাছ থেকে সুমিষ্ট রস, গুড় আহরণে কেবল আমাদের রসনা তৃপ্তির জন্য নয় আমাদের পরিবেশ ও প্রাণ প্রকৃতির ভারসাম্য সুরক্ষায় খেজুর গাছের আবাদ সম্প্রসারণ জরুরি। তিনি অারো বলেন, ভোলা জেলার মাটি সাধারণত বেলে দোঁ-আশ। আর পানিতে লবণাক্ততা নেই। ফলে গাছের শিকড় অনেক নিচে পর্যন্ত যেতে পারে। সব মিলিয়ে জলবায়ু উপযোগী ভোলার খেজুরের রস সুগন্ধি ও সুস্বাদু হয়ে থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.