সদরঘাট জিম্মি ‘খলিফা বাহিনী’র হাতে

এক সময় সদরঘাটের যাত্রীরা জিম্মি ছিলেন লাল বাহিনীর হাতে। সব কিছুতেই লাল বাহিনীকে হিস্যা দিতে হতো। সেই বাহিনীর দৌরাত্ম্য এখন আর নেই। কিন্তু জিম্মিদশা থেকে মুক্তি মেলেনি এখানকার নদীবন্দর হয়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ বিভিন্ন রুটে ভ্রমণকারী যাত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের। এখন ‘খলিফা বাহিনী’র হাতে জিম্মি সবাই।

সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে বিআইডব্লিউটিএ অভিযান চালিয়ে হকার উচ্ছেদ করলেও এর সুফল পাওয়া যায়নি; প্রতিটি লঞ্চেই জোরপূর্বক এ বাহিনী স্থান করে দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ হকারদের। যাত্রীদের নানারকম হয়রানি করা, তাদের মালামাল চুরি করা, এমনকি অজ্ঞান পার্টির সদস্যদের সঙ্গে যোগসাজশসহ বিস্তর অভিযোগ রয়েছে এসব হকারের বিরুদ্ধে।

জানা গেছে, খলিফা বাহিনীর প্রধানের নাম আসাদ খলিফা। তিনি বন্দরসংলগ্ন ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড (সূত্রাপুর) আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। একাধিক ভুক্তভোগী জানান, সদরঘাট নৌবন্দরে খলিফা বাহিনীর এতটাই আধিপত্য যে, এ এলাকায় তার ডিলারশিপ নেওয়া যাচ্ছেতাই তিনটি প্রতিষ্ঠানের পানি ছাড়া অন্য কোনো ব্র্যান্ডের বোতলজাত পানি পর্যন্ত বিক্রি করা যায় না।

এ ছাড়া লঞ্চগুলোর ক্যান্টিনের জন্য তার বাহিনীর কাছ থেকে মাছ, মুরগি ইত্যাদি বেশি দামে কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে লঞ্চ মালিকদের। শুধু তাই নয়, এ বাহিনীর মদদে লঞ্চের ক্যান্টিন দখলে নিয়ে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে তৃতীয়পক্ষের কাছে। লঞ্চে হকার বসিয়ে চাঁদাবাজি, অধিক মুনাফায় নি¤œমানের পানি বিক্রি, ক্যান্টিনে চড়া দামে খাদ্যপণ্য সরবরাহ এবং ক্যান্টিন দখল করে ভাড়া দেওয়া- এসবের বদৌলতে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী ৮০টি লঞ্চ থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে খলিফা বাহিনী।

এ বাহিনীর এহেন অরাজকতার জেরে ভীষণ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে যাত্রী, লঞ্চ মালিক ও এর স্টাফদের। জানা গেছে, ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আরিফ হোসেন ছোটনের মদদপুষ্ট এই খলিফা বাহিনী। ভোলার মনপুরা রুটে চলাচলকারী এমভি ফারহান-৫ লঞ্চে চড়ে নিজ এলাকায় ফিরছিলেন মনপুরা উপজেলা চেয়ারম্যান সেলিনা আক্তার চৌধুরী।

সেদিন লঞ্চে ভ্রমণকালে তিনি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন। এতে লেখা-‘ফারহান-৫ লঞ্চ মনপুরা যায়। যারা পানি কিনে খান, তারা দেখুন অবস্থা কী। নিম্নমানের পানি কিনে দোকান থেকে সরবরাহ করে। যাত্রীরা সাবধান হবেন। মালিকপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’ সেলিনা আক্তার চৌধুরী এই প্রতিবেদককে বলেন, নিম্নমানের লিলিয়া, রংধনু ও প্রিমিয়াম ব্র্যান্ডের পানি নিয়ে যাত্রীরা একাধিকবার লঞ্চ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেছেন। কিন্তু তারা এই পানি পানে বাধ্য করছেন।

এ বিষয়ে কথা হয় ফারহান লঞ্চ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। মালিকপক্ষেরই এক প্রতিনিধি জানান, আসাদ খলিফা উপরোল্লিখিত তিনটি ব্র্যান্ডের ডিলার। দীর্ঘসময় ধরে জোরপূর্বক ওই তিন ব্র্যান্ডের পানি প্রতিটি লঞ্চে সরবরাহ করা হচ্ছে তার পক্ষ থেকে। নয়তো তার বাহিনী জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দেয়। সামান্য ছুতা পেলেই লঞ্চে হামলা চালায় বহিরাগত সন্ত্রাসীরা।

ফারহান ৫-এর দোকান মালিক শামীম হোসেন বলেন, লঞ্চের কেবিনে নিম্নমানের পানি সরবরাহের কারণে প্রতিনিয়ত যাত্রীরা গালমন্দ করছেন। কিন্তু আমরা পানির ডিলারদের কাছে জিম্মি। এমভি জামাল, কর্ণফুলী লঞ্চ কর্তৃপক্ষেরও একই অভিযোগ। একাধিক লঞ্চ মালিকের অভিযোগ, টার্মিনালে যাত্রী হয়রানি বন্ধে বিআইডব্লিউটিএর টিম অনেক দিন ধরে হকার উচ্ছেদ করে আসছে।

কিন্তু চাঁদাবাজির সুবিধার্থে আসাদ খলিফার লোকজন প্রতিটি লঞ্চের ভেতরে এসব হকারকে দিয়ে ভ্রাম্যমাণ দোকান বসায়। এতে বাধা দিলে লঞ্চে হামলা ও ভাঙচুরের হুমকি দেওয়া হয়। থানাপুলিশে অভিযোগ দিলেও কোনো লাভ হচ্ছে না। আলাপ করে জানা গেছে, প্রতিদিন বিকালে লঞ্চ ছাড়ার সময় হকারপ্রতি ২৭০ টাকা করে আদায় করছে আসাদ খলিফার লাইনম্যানরা। ঘাটে এমন ৩ শতাধিক হকার রয়েছে।

এতে দিনে চাঁদা আসে ৮১ হাজার টাকা। বিআইডব্লিউটিএ সদরঘাট টার্মিনাল থেকে হকার উচ্ছেদে প্রায়ই অভিযান চালিয়ে থাকে। আদালতের নির্দেশে গত মঙ্গলবারও পুরান টার্মিনালের ২৭টি দোকান উচ্ছেদ করা হয়। যাত্রী হয়রানি বন্ধ এবং টার্মিনালটির আধুনিকায়নে তাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে-বিআইডব্লিউটিএর এমন ভাষ্য হলেও নতুন করে লঞ্চের ভেতরে হকার বসানোর বিপরীতে, কিন্তু দৃশ্যত কর্তৃপক্ষ কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক (বন্দর) আলমগীর কবির আমাদের সময়কে বলেন, যাত্রী হয়রানি বন্ধসহ ঘাটের পরিবেশ ঠিক রাখতে টার্মিনালে কোনো হকার থাকবে না। লঞ্চের ভেতরে যেসব হকার বসেছে, তাদেরও উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়। কিন্তু হকারদের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে তারা শুধু রমজান মাসে ব্যবসা করার সুযোগটা চান।

তবে আমরা লঞ্চের ভেতরে তাদের ৩০ মে পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছি। এর পর বিআইডব্লিউটিএ এলাকার মধ্যে কোনো হকার থাকতে পারবে না। জোরপূর্বক নিম্নমানের পানি, মুরগি-মাছ সরবরাহ, ক্যান্টিন দখলের বিষয়ে অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান তিনি। অভিযোগ রয়েছে, দূরপাল্লার লঞ্চগুলোর ক্যান্টিন নামমাত্র দামে জোরপূর্বক ভাড়া নেন আসাদ খলিফার লোকজন।

এর পর সেটি তৃতীয়পক্ষের কাছে উচ্চমূল্যে ভাড়া দেওয়া হয়। এ বাহিনীর কাছ থেকে চড়া মূল্যে ক্যান্টিনের মুরগি, মাছ কিনতে বাধ্য হচ্ছেন ক্যান্টিন বা লঞ্চ কর্তৃপক্ষ। এর জেরে শেষ পর্যন্ত বাড়তি অর্থ গুনতে হয় যাত্রীদের। যার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ, সেই আসাদ খলিফা অবশ্য তা পুরোপুরি অস্বীকার করছেন। আমাদের সময়কে তিনি বলেন, প্রতিটি লঞ্চে আমি বাকিতে বোতলজাত পানি সরবরাহ করি।

এ জন্য লঞ্চের লোকজনই আমার কাছ থেকে কিনছেন। এখনো প্রায় সব লঞ্চেই টাকা পাওনা আছি। মাছ-মুরগি সরবরাহ ও হকার বসানোর কথা অস্বীকার করেন আসাদ খলিফা। এসব অরাজক কর্মকাণ্ডের নেপথ্য মদদদাতা হিসেবে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই কাউন্সিলর আরিফ হোসেন ছোটনের মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করেও সাড়া মেলেনি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.